পালং খিয়াং ঝরনা – বান্দরবানের লুকানো এক রত্ন
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বান্দরবান জেলা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে স্বর্গের মতো। পাহাড়, ঝরনা, আদিবাসী সংস্কৃতি ও অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পার্বত্য অঞ্চল বছরের পর বছর ধরে ভ্রমণপিপাসুদের মন কেড়ে নিচ্ছে। বান্দরবানের অনেক বিখ্যাত ঝরনার মতোই একটি চমৎকার অথচ তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত ঝরনা হলো পালং খিয়াং ঝরনা। যাঁরা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন, ভিন্ন কিছু খোঁজেন—তাঁদের জন্য এই ঝরনা হতে পারে এক অমূল্য অভিজ্ঞতা।
পালং খিয়াং নামের অর্থ
‘পালং খিয়াং’ শব্দটি এসেছে স্থানীয় মারমা ভাষা থেকে। “খিয়াং” অর্থ জলপ্রপাত বা ঝরনা। “পালং” বলতে বোঝানো হয় একটি নির্দিষ্ট এলাকা বা গ্রামের নাম। অর্থাৎ, পালং খিয়াং মানে হলো ‘পালং এলাকার ঝরনা’। এই নাম থেকেই বোঝা যায় ঝরনাটি স্থানীয়দের কাছে কতটা পরিচিত ও প্রিয়।
ঝরনার অবস্থান
পালং খিয়াং ঝরনা বান্দরবানের রুমা উপজেলার অন্তর্গত। এটি মূলত রুমা বাজার থেকে ট্রেকিং করে যেতে হয়। পথে পড়বে বিভিন্ন পাহাড়ি গ্রাম, বাঁশের সাঁকো, কাদামাখা পথ আর ঘন সবুজ বনভূমি। পুরো ভ্রমণপথটাই যেন এক প্রকৃতির চিত্রশালা, যেখানে প্রতিটি বাঁকে আছে নতুন চমক।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে প্রথমে যেতে হবে বান্দরবান শহরে। সেখান থেকে বাস বা জিপে রুমা বাজার। রুমা বাজার থেকেই মূল ট্রেকিং শুরু হয়। সাধারণত স্থানীয় গাইড ছাড়া যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ও নিষিদ্ধ। রুমা বাজার থেকে গাইড ভাড়া করে নিতে হয়, যারা পথ চিনে ও পাহাড়ি ভাষাও জানে। ৬-৭ ঘণ্টার ট্রেকিং পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় পালং খিয়াং-এর গহীনে।
যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা
পথে যেতে হয় কেওক্রাডং বা বগা লেক যাওয়ার ট্রেইলের মতোই দুর্গম পথে। হালকা ট্রেকিং নয়—এটা সত্যিকার ট্রেকিং, যার জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি দরকার। পথে পাওয়া যাবে ছোট ছোট ঝরনা, বাঁশের ব্রিজ, পাহাড়ি গ্রাম এবং নানা রকম গাছপালা। মাঝে মাঝে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ নাও করতে পারে, তাই টিম স্পিরিট আর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাই একমাত্র সঙ্গী হয়।
পালং খিয়াং ঝরনার সৌন্দর্য
পালং খিয়াং ঝরনা নিজে দেখতে যতটা না বিশাল, তার চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় তার অবস্থান ও পরিবেশ। ঝরনাটি পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে, যেখানে সূর্যের আলো খুব কম আসে। ফলে ঝরনার চারপাশ সবসময় ঠাণ্ডা ও স্নিগ্ধ থাকে। জলধারাটি সরু পথে বেয়ে নেমে আসে এক প্রাকৃতিক জলাশয়ে, যেখানে স্নান করাও যায়। ঝরনার শব্দ আর চারপাশের নির্জনতায় তৈরি হয় এক অপার্থিব পরিবেশ।
ঝরনার গায়ে শ্যাওলা, বুনো লতা আর পাথরের গায়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে গড়িয়ে তৈরি হয় এক মনকাড়া দৃশ্য। এখানে বসে কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়—কোনো মোবাইল, কোনো শহরের কোলাহল নেই—শুধু প্রকৃতির নিঃশব্দ ডাক।
থাকার ব্যবস্থা
পালং খিয়াং ঝরনার খুব কাছে থাকার সুযোগ নেই, তবে রুমা বাজারে কিছু গেস্টহাউস ও হোমস্টে পাওয়া যায়। যাত্রাপথে কোথাও ক্যাম্পিং করেও রাত কাটানো যায়, তবে তার জন্য আগে থেকেই অনুমতি ও প্রস্তুতি নিয়ে যাওয়া দরকার। অনেক পর্যটক বগা লেক হয়ে ঘুরে পালং খিয়াং যাওয়ার পরিকল্পনা করেন।
সেরা সময় ভ্রমণের
বর্ষাকাল ও বর্ষার পরপরই পালং খিয়াং ঝরনা সবচেয়ে আকর্ষণীয় থাকে। তখন ঝরনার পানি বেশি থাকে এবং প্রকৃতি আরও সবুজ আর প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তবে বর্ষাকালে ট্রেকিং কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। অক্টোবর থেকে মার্চ—এই সময়টুকু ঝরনাটি ঘুরে দেখার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।
প্রয়োজনীয় কিছু টিপস:
-
- অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া যাবেন না।
-
- হালকা ব্যাকপ্যাক নিন, ভারী লাগেজ বিপদ ডেকে আনতে পারে।
-
- পানির বোতল, হালকা শুকনো খাবার, ফার্স্ট এইড কিট ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখুন।
-
- ভালো মানের ট্রেকিং জুতা এবং রেইন কোট অবশ্যই প্রয়োজন।
-
- প্রকৃতিকে ভালোবাসুন, কোনো ময়লা-আবর্জনা ফেলে আসবেন না।
পালং খিয়াং শুধু একটি ঝরনা নয়—এটি এক যাত্রা, এক অভিজ্ঞতা। পাহাড়, বন আর নিস্তব্ধ প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার যে অনন্য সুযোগ এটি দেয়, তা খুব কম জায়গায় পাওয়া যায়। যারা প্রকৃতিকে সত্যিকারের হৃদয়ে অনুভব করতে চান, তাঁদের জন্য পালং খিয়াং হতে পারে স্মরণীয় এক গন্তব্য।